সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:২৪ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিনিধি॥ আব্দুল হান্নান (২০) এর বাড়ি বরগুনা জেলার আমতলী উপজেলার দক্ষিণ তক্তা বুনিয়া গ্রামে। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী হান্নান এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তার বাবা নাসির প্যাদা একজন প্রান্তিক কৃষক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুককে ব্যবহার করে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখে হান্নান বেছে নেয় অভিনব এক পন্থা। ফেসবুকে সে একাউন্ট খুলে কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. মাশরুকুর রহমান খালেদ এর নামে।
পুলিশ সুপারের ছবি প্রোফাইল ও কভার ফটো হিসেবে ব্যবহার করে সেই আইডি থেকে পোস্ট দিতে থাকে কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপারের দৈনন্দিন নানা কার্যক্রমের ছবি। এভাবে পুরোদস্তুর নিজেকে কিশোরগঞ্জের এসপি হিসেবে ফেসবুকে তুলে ধরে। টার্গেট হিসেবে বেছে বেছে ফ্রেন্ড হিসেবে এড করে হাই অফিসিয়াল, রাজনৈতিক নেতা, আইনজীবী ও ব্যবসায়ীদের। বিশেষ করে ধনী মেয়েরা ছিল তার প্রধান টার্গেট।
নিজেকে অধরা রাখতে কিশোরগঞ্জের কোন ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট গেলে তাকে সে ব্লক দিতো। এভাবেই প্রতারণা আর অপকর্মের ফাঁদ পাতে ধূর্ত হান্নান। গলার স্বর বদলে বন্ধু তালিকায় থাকা ধনী মেয়েদের সাথে মেসেঞ্জারে কথা বলতো হান্নান। চ্যাট আর মেসেঞ্জারের মাধ্যমে তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠে সে। আর এভাবে একের পর পর আর্থিক প্রতারণা আর অপকর্মের ঘটনা ঘটায় সে।
ফেসবুকে কিশোরগঞ্জের এসপি পরিচয়ে হান্নানের এমন প্রতারণার শিকার হওয়া একাধিক নারী কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. মাশরুকুর রহমান খালেদ, বিপিএম (বার) এর সরকারি নম্বরে জানানোর পর ফাঁস হয় হান্নানের ছদ্মবেশে এই প্রতারণার বিষয়টি।
এ ব্যাপারে কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানায় করা হয় জিডি। পুলিশ সুপার মো. মাশরুকুর রহমান খালেদ বিপিএম (বার) সহায়তা চান সাইবার ক্রাইম ইউনিট ও পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের ইন্টিলিজেন্স শাখায়। সাইবার ক্রাইম ইউনিট ও পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের ইন্টিলিজেন্স শাখা উদঘাটন করে কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. মাশরুকুর রহমান খালেদ এর নামে ভুয়া ফেসবুক আইডি চালাানোর বিষয়টি। সনাক্ত করে আইডিটির মাধ্যমে প্রতারণা আর অপকর্মকারী যুবক আব্দুল হান্নানকে। পরে কিশোরগঞ্জ জেলা পুলিশের রিক্যুইজিশনে বরগুনা জেলা পুলিশ বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরে বরগুনার আমতলীর বকুলনেছা সরকারি মহিলা কলেজ রোড থেকে তাকে আটক করে।
বরগুনা থেকে কিশোরগঞ্জ নিয়ে আসার পর শুক্রবার (৬ সেপ্টেম্বর) কিশোরগঞ্জের আদালতে হাজির করে হান্নানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানান এ ব্যাপারে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার পরিদর্শক (অপারেশন) মো. সোহরাব মিয়া। আদালত থেকে আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হওয়ার পর শুক্রবারই তাকে রিমান্ডে নেয় পুলিশ।
শনিবার (৭ সেপ্টেম্বর) দুপুরে কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ফেসবুকে কিশোরগঞ্জের এসপি সেজে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আব্দুল হান্নানের এসব প্রতারণা আর অপকর্মের বিবরণ দেন পুলিশ সুপার মো. মাশরুকুর রহমান খালেদ বিপিএম (বার)। এ সময় পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পাওয়া কিশোরগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. নাজমুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) মো. মিজানুর রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) অনির্বান চৌধুরী, কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি মো. আবুবকর সিদ্দিক সহ জেলা পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
পুলিশ সুপার মো. মাশরুকুর রহমান খালেদ বিপিএম (বার) প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের জানান, চলতি বছরের পহেলা জুন অথবা এর আরও আগে থেকে কতিপয় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি প্রতারণার মাধ্যমে সম্পূর্ণ ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে কিশোরগঞ্জ পুলিশ সুপার নাম ব্যবহার করে ছবি সম্বলিত ‘মাশরুকুর রহমান খালিদ’ নামে আইডি খুলে বিভিন্ন সময়ে ফেসবুক কার্যক্রম করে আসছিল। এই আইডিতে পুলিশ সুপার কিশোরগঞ্জের ছবিসহ অন্যান্য অফিসারদের ছবি এবং পুলিশ সুপার, কিশোরগঞ্জের উপস্থিতিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ছবি যেমন- প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর সাথে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ছবি আপলোড করে আসছিল। অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা ডিজিটাল অপরাধী চক্রের সদস্য। দীর্ঘদিন যাবত পুলিশ সুপার কিশোরগঞ্জকে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান পরিচয় জেনেও ছদ্মবেশ ধারণ করে ডিজিটাল জালিয়াতি করে আসছিল। এর মাধ্যমে ব্যবসায়ী, আইনজীবী ও রাজনীতিকসহ চার জনের সঙ্গে প্রতারণার বিষয়টি এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া গেছে বলে জানান পুলিশ সুপার।
এ ঘটনায় গত মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়। পরে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ডিজিটাল প্রতারক আব্দুল হান্নানকে সাইবার ক্রাইম ইউনিট, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের ইন্টিলিজেন্স শাখা ও বরগুনা জেলা পুলিশের সহযোগিতায় বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) বরগুনা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপারের নামে ভুয়া আইডি খুলে প্রতারণার কথা স্বীকার করেছে হান্নান। দারিদ্রতার কারণে এই পথ বেছে নিয়েছে বলেও সে জানিয়েছে।
Leave a Reply